একটা ছবি তোলার জন্য স্টুডিও নামক দোকানে যাওয়া লাগতো।
সে একটা সময় ছিলো, একটা ছবি তোলার জন্য স্টুডিও নামক দোকানে যাওয়া লাগতো। ছবি তোলার ৩ থেকে ৭ দিন পর ছবি হাতে পাওয়া যেতো। একটা ফিল্মে ৩৬টা ছবি ধরে, সবগুলো শেষ হওয়ার পর দোকানদার ওয়াশ করার জন্য সেটা আরেক জায়গাতে পাঠাবে। আপনার ছবি যদি ১ এ থাকে তবে বাকি ৩৫টা শেষ হবার পর আপনার ছবি হাতে আসবে! অপশন ছিল দুইটা, সাদা কালো আর রঙ্গিন। সাদাকালোর এক রেট রঙ্গিনের আরেক রেট। স্টুডিওর ভেতরে দেখতাম সস্তা ধরনের পাওডার থাকতো, একটা বড় আয়না থাকত। কেউ হয়ত তাড়াহুড়া করে আসছে মেকাপ করার সময় পায়নি, তখন ওই পাউডার দিয়ে হালকা প্রলেপ দিয়ে নিতো মুখে। অনেকে একটু ফর্শা দেখাবে এই ভেবে এমন মাখা মাখতো যে চেহারা চেনা মুশকিল হয়ে যেতো। অনেক পুরুষ মানুষও দেখেছি ফ্রিতে পাওয়া সে পাওডার ব্যাপক মাখা মাখতো। অফিসিয়াল ছবি লাগবে? কোট টাই নেই? কোনও ব্যাপার না, থাকত রেডিমেট কোর্ট ও টাই। নিচে লুঙ্গি কিন্তু উপরে কোর্ট টাই! বুকের কাছথেকে তোলা হতো বলে লুঙ্গি আউট অফ ফোকাসে থাকতো।
আসল কাহিনী শুরু হইত ছবি তোলার সময়। একটা টুলের উপর বসাবে প্রথমে, তারপর ক্যামেরা ম্যান ক্যামেরার পেছনে যেয়ে এমন একটা ভাব করবে যেন সে জেমস ক্যামারুন!
মাথা একটু ডাইনে
উহু আরেকটু ডাইনে
বেশি হইছে হালকা বামে চাপান
মুখ একটু উচু হবে
অতটা না আরেকটু নামান
হালকা হাসুন
নানা আরেকটু
ঘার ব্যাকা হইছে
হাতের আঙ্গুল সোজা করেন
পিঠ টানটান করেন
আরেকটু ইজি হন
চোখ খোলা রাখেন
এতো কিছুর পরও ক্যামেরা ম্যান নিজে যেয়ে এবার হাত দিয়ে মাথাটা ঠিক করে দেবে। তারপর ক্যামেরার পেছনে যেয়ে বলবে ওকে? প্রথমবার দেখা গেলো ক্যামেরার ফ্লাশ পড়েনাই, আবার নতুন করে শুরু ঘার কাত করা মাথা বাকানো!
স্টুডিওর ভেতরে পাহাড় পর্বত নদী নালা খাল বিল বন জঙ্গল ইত্যাদি আকা ব্যানার টাইপ এক ধরনের কাপড় থাকতো। সেটা পেছনে দিয়ে প্রাকৃতিক একটা ব্যাকগ্রাউন্ড করা হতো। সেই কাপড় পিছনে নিয়ে ব্যাকা, সোজা, দাড়িয়ে, গালে হাত দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমাতে ছবি তোলা হইতো। ছবি ডেলিভারি দেওয়ার সময় সাথে নেগেটিভ দিয়ে দিতো, সেটা আবার যত্ন করে তুলে রাখা লাগত, পরে সেটা দিয়ে পুনরায় ছবি ওয়াশ করার জন্য। এতো কিছুর পরও ফাইনালি দেখা যেতে কারো চোখ বন্ধ উঠছে, কারও দাত বের হয়ে আছে, কারও ঘাড় বেকে গেছে, কারো মাথা কাটা পড়ছে! মানুষ সিনেমা দেখার মতো করে দল বেধে ছবি তুলতে যাইতো। পালা পার্বনে ছবি তোলা একটা ট্রাডিশন হয়ে গিয়েছিলো। সেই সব ছবি আবার বড় করে বৈঠকখানাতে বাধিয়ে রাখা হতো!
ফটো স্টুডিও এখনও আছে। শুধু প্রযুক্তি পালটেছে। এখন ছবি তোলার সাথে সাথে ডেলিভারি। একটা কম্পিউটার আর একটা ক্যামেরা থাকলে মিনি স্টুডিও করা যাচ্ছে। ফটোশপ করে চেহারা আমুল পরিবর্তন করা যাচ্ছে। সেই এনালগ ক্যামেরার জায়গা দখল করেছে ডিজিটাল ক্যামেরা। আপনি নিজেকে যেমন দেখতে চান ঠিক তেমন করে দেখানো সম্ভব।
নিজের ছবি নিজে তোলা যায় এটা তো পরের ব্যাপার, স্টুডিওর বাইরে যে ছবি তোলা যায় সেটাই মফস্বলের মানুষ কোনদিন ভাবেনি। তারা ছবি তোলা বলতে স্টুডিও বুঝতো। সেই জায়গা থেকে আজ আমরা কোথায় ভাবা যায়? এখন প্রতিটা মোবাইলের সাথে ক্যামেরা বিল্টইন। সেই মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে আমরা বাথরুমের আয়নার সামনে দাড়িয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলি। প্রতিটা মুহুর্ত আমরা বন্দি করে রাখি মোবাইল ক্যামেরাতে। নুনু কাটা থেকে শুরু করে মৃত মানুষ পর্যন্ত যতগুলো ধাপ আছে সবগুলো কভার করছি। বাদ যাচ্ছেনা কিছুই। অনেকে বিশেষ কিছু দৃশ্য ধারন করে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। লাইভ মার্ডার, লাইভ রেপ, লাইভ হরতাল গন্ডগোল মারামারি কাটাকাটি সব কিছুই তোলা যাচ্ছে। নিজের ছবি নিজে তোলার নাম দেওয়া হয়েছে সেলফি। সম্প্রতি সেলফি শব্দটা অফিসিয়ালি ইংরেজি অভিধানে যুক্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার যেটা, যে কথাটা বলার জন্য এই মহাভারত লিখছি, সেটা হচ্ছে- মনোবিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন সেলফি এক ধরনের মানুসিক বিকারগ্রস্থতা! তাদের ধারনার পেছনে কি যুক্তি আছে জানিনা, তবে আমারও মনে তাই বলে। একটা মানুষ বাথরুমের আয়নার সামনে দাড়িয়ে বাকাচোরা হয়ে নিজের ছবি নিজে তুলছে! তারে মানুসিক রুগী বলার জন্য মনোবিজ্ঞানী হওয়া লাগে নাকি!